আলোর হাতছানি

আলোর হাতছানি
-অনিন্দ্য ভুক্ত

 

রোজ বিকেলে এখানেই আড্ডা বসে ওদের। পাঁচটা থেকে সাতটা।আজ আসতে একটু দেরীতে হয়ে গেল অলোকের। এসে দেখে কেউ কোথাও নেই। গেল কোথায সব, ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেল টী-টোয়েন্টির ম্যাচ চলছে। আজ আর অতোএব কারো টিকিটি পাওয়া যাবে না।
মনটা তিতকুটে হয়ে গেল। এই এক ঝামেলা হয়েছে। আরে বাবা, খেলতে পারলে নিজে খেলো না। তা নয় পরের খেলা দেখে সময় নষ্ট।গলাও নষ্ট, চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে। বসে বসে খেলা দেখার চেয়ে আড্ডা মারা বোধহয় ঢের গুণ ভালো।
খানিকক্ষণ গুম হয়ে মাঠের ধারে বসে রইলো অলোক। একা একা করবেটাই বা কি? কারো বাড়ী যাবে, সেখানেও তো সব হাঁ করে টিভি গিলছে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে উঠে পড়লো। আজ জঙ্গলে ঢুকবে। অন্যদিন কথাটা উঠলেই সবাই হাঁ হাঁ করে ওঠে। আজ নিশ্চিন্তে ঢোকা যাবে।
কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখল অলোক।চারটে বাজে সন্ধে গড়াতে তার মানে এখনো ঘন্টা আড়াই। বেশীদূর না ঢুকলেই হলো, বেলাবলি ফিরে আসা যাবে। খেলা দেখে রতনরাও হয়তো ততক্ষণে মাঠে এসে যাবে।
গ্ৰামের শেষ প্রান্তে এই মাঠ। আর মাঠ যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকেই শুরু জঙ্গলের। লম্বায় চওড়ায় প্রকান্ড এক জঙ্গল। যেমন পেল্লায় তেমনি ঘন। ওরা বলে পাগলাঝোরার জঙ্গল।কেন বলে সে অবশ্য কেউ জানে না। ঘন জঙ্গল বলেই হয়তো বা দিনের বেলাতেই আলো ঢোকে খুব কম। তবে সেটা জঙ্গলের মধ্যে কিছুটা ঢুকলে তারপর। দিনদুপুরে সামনাসামনি সবাই ঢোকে, ওরাও কতবার ঢুকেছে, কিন্তু বেলা পড়লে কেউ আর জঙ্গলের পথ মাড়াতে চায় না। অলোকের বহু দিনের ইচ্ছে ও জঙ্গলের গভীরে ঢুকবে, তাও আবার বিকেলের দিকে। ও দেখতে চায় কি আছে বিকেলের জঙ্গলে, কিন্তু বন্ধুরা ঢুকতে দিলে তবে তো।
বেশী ভাবনা না বাড়িয়ে চট করে ঢুকে পড়লো অলোক। সামনের দিকে চেনা অংশটুকু পেরিয়েও এলো দ্রুত।আর চেনা অংশটা পেরিয়ে আসতে আসতেই মুগ্ধতা বাড়ছিলো। কত নাম না জানা গাছ, কত অচেনা ফুল,কত অজস্র পাখির কিচিরমিচির। আরো খানিকটা ঢুকে আসতে বিস্ময় বেড়ে গেল অলোকের।আলো আসছে।জঙ্গল এখানে যেন একটু পাতলা। বিকেলের পড়ন্ত লালচে আলোয় মনে হচ্ছে যেন জঙ্গলে আগুন লেগেছে। দাঁড়িয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু দাঁড়ালে চলবে না। ভেতরে আরো কত কি দেখবার আছে কে জানে! অলোকের নেশা ধরে যাচ্ছিলো।
আরো একটু ভেতরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেল ও। কি বিশাল দীঘি! পদ্মদীঘি। নিজের মনেই নাম দিয়ে ফেললো।আর এগোতে ইচ্ছে করছিলো না। পা দুটো কেউ যেন মাটির সঙ্গে আটকে দিয়েছে। হঠাৎই অলোক দেখলো দীঘির একপাশের জলে যেন কালো ছায়া পড়লো। প্রথমটায় চমকে উঠলেও অলোক বূঝতে পারলো গাছের আড়ালে সূর্য নেমে যাচ্ছে।
সর্বনাশ বুঝে ওঠার আগেই ঝপ করে অন্ধকার নেমে এলো। নিকষ কালো অন্ধকার। যতই সাহসী হোক,এই অবস্থায় ভীতু আর সাহসীর মধ্যে কোনো প্রভেদ থাকে না। অলোকের মনে হচ্ছিল ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। কষ্ট করে মনের জোর ফিরিয়ে ও পিছূ ফিরে হাঁটা লাগাল। জঙ্গলে অন্ধকার নামে আগেই। ঘড়ির কাঁটা বলছে এখন ছটা। তার মানে বাইরে এখনো আলো আছে। তাড়াতাড়ি পা চালালে এখন ফেরা যাবে।
কিন্তু চালাবো বললেই তো আর চলে না। অন্ধকারে আন্দাজে আন্দাজে এগোনো। হাতড়ে হাতড়ে এগোতে এগোতেই হঠাৎ দূরে একটা আলোর রেখা চোখে পড়লো। মনে একটু ভরসা এলো যেন। কেন যে আলো ভয় কাটিয়ে দেয় কে জানে! অলোকের গতিবেগ দ্রুত হলো আলোর বিন্দুর দিকে চেয়ে।
কয়েক মিনিট হাঁটার পর খেয়াল হল ও আলোর কাছাকাছি পৌঁছতে পারছে না,বরং আলো যেন আরো দূরে সরে যাচ্ছে। আরো জোরে পা ফেলতে হবে। হঠাৎ ই আলোর বিন্দু দুটো হলো। কিন্তু দুটো আলো তো পাশাপাশি নয়। অলোক বিভ্রান্ত বোধ করলো। কোন দিকে যাবে? ঠিক করে ওঠার আগেই আবার একটা আলোর বিন্দু ফুটে উঠল চোখের সামনে,ঠিক যেমন আকাশে তারা ফুটে ওঠে, সেভাবেই যেন।
দেখতে দেখতে আলোর মালার মধ্যে যেন আটকে গেল অলোক। অমাবস্যার রাতের মত যেন এক তারায় ভরা আকাশ। অলোকের মনের থেকে ভয় চলে গেল। ও মুগ্ধ হয়ে আলোর মালা দেখছিলো। আস্তে আস্তে আলোর বিন্দুগুলো নাচতে শুরু করল ওর চোখের সামনে। কেউ যেন মন্ত্রের মতো অবশ করে দিচ্ছিল অলোককে।। হঠাৎ ই অলোক আবিস্কার করল ও সেই পদ্মদীঘির সামনে দাঁড়িয়ে। এতোক্ষণ কি তাহলে ও এই দীঘির চারপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছিলো!
ভালো করে দীঘির দিকে তাকিয়েই আঁতকে উঠল সে। একটা হাত। হাতটা ডুবে যেতে যেতে যেন ভেসে উঠছে। বুঝতে দেরী হল না অলোকের। কতবার যে এমন ডুবন্ত মানুষকে বাঁচিয়েছে ও! কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, কেন দাঁড়িয়ে আছে,সব ভুলে ঝাঁপ মারলো অলোক।
পরদিন সকালে অলোককে খুঁজতে খুঁজতে গ্ৰামের লোক পাগলঝোরার জঙ্গলের সেই ভেতরে ঢুকে এলো, যেখানে এর আগে কখনো আসেনি তারা। এসে দেখলো দীঘির পাড়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে অলোক।তার ডান হাতটা সামনে বাড়ানো, ঠিক যে ভঙ্গীতে তাকে গ্ৰামের পুকুরপাড়ে আগেও অনেকবার দেখেছে সবাই।

Loading

Leave A Comment